আমি আড্ডাবাজ খাবারপ্রিয় মানুষ। আশপাশের সব মানুষদের নিয়ে খেতে পছন্দ করি, রান্না করতে ভালবাসি। আমার এই স্বভাবের পিছনে অন্যতম একটা কারণ হলো ছোটবেলার গ্রুমিং। কয়েকবার বাসা বদলে নতুন এলাকায় গিয়ে থাকলেও প্রতিবেশী আর পাড়া-মহল্লার মানুষের সাথে একটা অন্যরকম সম্পর্ক হয়ে যেতো। তখনকার সময়ে অবশ্য স্মার্টফোন আর ক্যাবল লাইন মানুষকে কব্জা করে ফেলতে পারে নাই। মানুষের মধ্যে ধৈর্য ছিল,পাশের বাড়ির খবর নেয়ার মতন সময় ছিল। আমরা একে অপরের নাড়ি নক্ষত্র সব জানতাম।
সেই সময়ে একটা কালচার ছিল রান্না করার সময় হটাৎ তেল-নুন ফুরিয়ে গেলে পাশের বাসা থেকে আনা। কিছু একটা শেষ হলেই আম্মু পাঠাতো পাশের বাসা থেকে অল্প করে নিয়ে আসতে। ছোট বাটিটা যখন অর্ধেকের বেশি ভরে উঠতো তখনই আন্টিকে বলা শুরু করতাম
-"আর লাগবে না, লাগবে না, আর দিয়েন না!!"
আন্টি আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বাটি উপচে লবণ পড়ার আগ পর্যন্ত ঢালতে থাকতো। যেই জিনিসের জন্যই যেতাম প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিয়েই আন্টি আমাকে বাসায় ফেরত পাঠাতো। অবশ্য একই রকম কাজ আম্মুও করতো। পরে বাবা বাজার করে আনার পর কর্জ করে আনা ওই জিনিস আবার ফেরত পাঠানো হতো।
আমার মনে হয় এরকম কিছু লাগলে পাশের বাসায় যাওয়ার কালচারটা একরকম উঠেই গেছে। এখন আমাদের বাসা পাল্টেছে। প্রায় দশ বছর হয়তো হবে আম্মু পাশের বাসা থেকে কিছু আনে না। বাজার লাগলে হাতের কাছেই স্টোর। একটা ফোন কলেই চালডাল বাসায় চলে আসে। খাওয়ার টেবিলে না বসলে বাবা জানেও না বাসায় কি বাজার হয়েছে। মাছ মাংসের মতন বড় বাজারগুলা আনার জন্য মাসে দুই তিন বার বাবার বাজার যাওয়া হয়।
অথচ এই বাবাই আমার জন্মের সময়ে প্রতিদিন সকাল বেলা বাজারের ব্যাগ হাতে করে নিয়ে বাজার করতে বের হতো। ওই সময়ে ডেইলিকার বাজার ডেইলি করার একটা চল ছিল। মাছ মাংস সবজী এনে ফ্রিজ বোঝাই তেমন কেউ করতো না। অবশ্য সেই সময়ে ফ্রিজ সবার বাসায় ছিলও না, থাকলেও ছোট খাটো। আমাদের বাসার হালকা সবুজ রঙের ফ্রিজটা হাইটে হয়তো চার ফিটের বেশি ছিল না।
এখন প্রতিদিন সকালে গিয়ে বাজার করার মতন সময় বা সুযোগ আমাদের নাই। বা এসব থাকলেও এত কষ্ট করার মতন ইচ্ছাটা নাই। এর জন্য সহজপ্রাপ্যতা অনেকটা দায়ী। আমরা মর্ডান কালচার বলতে বুঝি সবকিছুই হাতের নাগালে থাকতে হবে। পান্ডা মার্ট, চাল-ডালের মতন অ্যাপ থাকার সুবাদে নিজে থেকেই বাজার বাসায় চলে আসছে।
কিন্তু বাজার করা যে একটা আর্ট বা শেখার জিনিস এটা আমাদের পরবর্তী জেনারেশন পাচ্ছে না, যেই জিনিস আমরা বংশ পরম্পরায় শিখে এসেছি। প্রফেসর রাজ্জাক সাহেবের ভাষায় -একটা জায়গা কেমন তা ভাল মতন চিনতে হলে সেখানের বাজার আর লাইব্রেরিতে যাওয়া উচিত। এই কথার যথার্থতাও এখনকার পশ প্রজন্ম অনেকেই বুঝবো না।
আমার কাছে মনে হয় বাচ্চারা যদি না বুঝে খাবারটা কোথা থেকে কিভাবে আসছে তাহলে খাবার অপচয়টা সবচেয়ে বেশি হয়। এই জিনিসটা আরও বেশি রিয়েলাইজ করেছি তত্তোচান বইটা পড়তে গিয়ে।
তত্তোচান জাপানিজ একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী। খাবারের মাহাত্ম্য বুঝাতে তাদের প্রিন্সিপাল বাচ্চাদের নিয়ে ধান ক্ষেতে চলে যেতো। কৃষকদের সাথে কথা বলে ছোট ছোট বাচ্চারা নিজেরাই একবার ধানের চারা বুনেছিল। জেনেছিল কিভাবে বীজ থেকে চারা,চারা থেকে ধান হয়। এক মাস পর বাচ্চাদের আবারও সেই ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দেখানোর জন্য তাদের রোপন করা চারা কত বড় হয়ে গেছে।
শুধু তাই না, শিক্ষকরা বাচ্চাদের নিয়ে বনে বাদরে পিকনিক করার জন্যও নিয়ে যেতো। সামার ক্যাম্প যাকে বলে। আমরা যেখানে বাচ্চাদের প্রটেকশন দেয়ার জন্য ছুরি কাঁচি থেকে দূরে রাখি, সেখানে তত্তোচানরা নিজেরা ফলমূল মাংস কেটে খড়ি দিয়ে রান্না করেছিল। একদল প্রি প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চা এসব করছে এ তো আমরা এখানে কল্পনাও করতে পারিনা।
এত কিছু করার জন্য বাচ্চারা খাওয়ার সময় নিজে থেকেই শুকরিয়া আদায় করে নিতো। খাবারটা কিভাবে তাদের কাছে এসেছে তার মর্ম বুঝতো। যার ফলে কখনও আর অপচয় করতো না।
আমার কাছে মনে হয় সব বাচ্চাকেই খাবার তৈরি করার পদ্ধতির সাথে হাতে কলমে পরিচয় করিয়ে দেয়া উচিত। ক্ষেত চাষ করা থেকে শুরু করে বাজার করা, বাসায় রান্না সবকিছুর সাথে যখন পরিচিত হবে তখন খাবারের প্রতি মায়াটাও বাড়বে।
(নিজের রান্নার ছবি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না 😛)
খারাপ লাগে দিনকে দিন আমাদের খাওয়া দাওয়ার কালচারটা কিভাবে জানি বদলে যাচ্ছে। আমরা প্রোসেসড ফুডের প্রতিই নির্ভর হয়ে যাচ্ছি,কারণ রান্না করার মতন সময় বের করতে পারছিনা। সিঙ্গাপুরের মতন দেশগুলোর নতুন অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় রান্নাঘরই উঠিয়ে দিচ্ছে। ভাবতেও অবাক লাগে! সামনে কি আসবে কে জানে!